পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ করছেন ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের কৃষকরা। সম্প্রতি রাজ্যের নাসিক জেলা থেকে রাজধানী মুম্বাই পর্যন্ত লংমার্চ কর্মসূচীর ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। নাসিক থেকে মুম্বাইয়ের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার (১২৪ মাইল)।
বিবিসির মহারাষ্ট্র শাখা বিবিসি মারাঠির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারি ভাবে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ও নতুন দাম ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন রাজ্যের কৃষকরা। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের কিছু পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রদানের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আন্দোলনরত কৃষকরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
নাসিক জেলার বাসিন্দা নামদেব ঠাকরে বিবিসিকে জানান, গত নিজেদের বিস্তৃত পারিবারিক খামারের বিপুল পরিমান জমিতে পেঁয়াজের ক্ষেত করেছিলেন তিনি। কিন্তু মৌসুম চলে যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত সেসব পেঁয়াজ তুলতে পারেননি তিনি। ফলে মণের পর মণ পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতেই।
কী কারণে তুলতে পারেননি— বিবিসির এ প্রশ্নের উত্তরে নামদেব বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে পেঁয়াজের যে দাম, তাতে মজুর নিয়োগ করে ক্ষেত থেকে পেঁয়াজ তুলে বাজারে বয়ে আনতে যে ব্যয় হবে— তা ই উঠবে না। চাষের খরচ বাদই দিলাম।’
নামদেব একা নন, মহারাষ্টের হাজার হাজার কৃষকের অবস্থা এখন তার মতোই। সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রায় সব রাজ্যে পেঁয়াজের দাম ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এদে নিদারুন বিপাকে পড়েছেন ভারতের লাখ লাখ কৃষক।
পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বের এক নম্বর দেশ চীন, তারপরেই ভারত। প্রতি বছর ২ কোটি ৪০ লাখ টন পেঁয়াজের উৎপাদন হয় দেশটিতে; এবং মহারাষ্ট্র ভারতের পেঁয়াজের ভাণ্ডার নামে পরিচিত। দেশটির মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের অর্ধেকই আসে পশ্চিমাঞ্চলীয় এই রাজ্যটি থেকে।
কৃষিজাত এই ফসলটির চাহিদাও ভারতে প্রচুর। সবজি এবং মসলা— উভয় হিসেবেই এটি অপরিহার্য দেশটির প্রায় সব রাজ্যে। নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর মোট উৎপাদনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি করে ভারত।
তবে মিষ্টি জাতীয় খাবার ব্যতীত অধিকাংশ ভারতীয় ডিশে পেঁয়াজ অপরিহার্য হলেও দেশটির পেঁয়াজের বাজার খুবই অস্থিতিশীল। কারণ, স্বাভাবিক তাপমত্রায় এই সবজি বা মসলাটি দ্রুত পচে যায় এবং হিমাগারে নিজেদের পেঁয়াজ সংরক্ষণের সুবিধা দেশটির অধিকাংশ কৃষকের নেই।
আবার এই সবজি বা মসলাটি একই সঙ্গে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিকও। বাজারে যদি সরবরাহ হঠাৎ বেড়ে যায় তাহলে দাম কমে যায় পেঁয়াজের, ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা। আবার সরবরাহ যদি হঠাৎ কমে যায়— তাহলে দাম বেড়ে যায় এবং ক্ষোভ শুরু হয় সাধারণ ভোক্তাপর্যায়ে।
ভারতের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কমে যাওয়ার কারণ নিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এক সময় মহারাষ্ট্রে অনেকটা একচেটিয়াভাবে পেঁয়াজের চাষ হতো। কিন্তু বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থানসহ আরও কিছু রাজ্যে পেঁয়াজ চাষ বাড়ছে। এ কারণে বাজারে সরবরাহ আসছে প্রচুর, দামও হ্রাস পেয়েছে।
খামার বিশেষজ্ঞ শ্রীকান্ত কুয়ালেকার অবশ্য বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব চলতি মৌসুমের পেঁয়াজচাষে প্রভাব ফেলেছে। বিবিসি মারাঠিকে তিনি বলেন, ভারতে দুই মৌসুমে পেঁয়াজের চাষ হয়— বর্ষাকাল ও শীতকাল। বর্ষাকালে যে পেঁয়াজ ক্ষেতে রোপন করা হয়, তা সাধারণত তোলা হয় ডিসেম্বরের শেষ দিকে কিংবা জানুয়ারির শুরুর দিকে। এই মৌসুমের পেঁয়াজ শীতকালীন পেঁয়াজের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দ্রুত পচনশীল হওয়ায় ক্ষেত থেকে তোলার পরপরই এগুলো বাজারজাত করতে হয় কৃষকদের। শীতকালীন পেঁয়াজে অবশ্য সেই সমস্যা নেই, ক্ষেত থেকে তোলার পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায়ও সেগুলো দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
‘গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে মহারাষ্ট্রে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। তাই কৃষকরা খানিকটা দেরিতে ক্ষেতে পেঁয়াজ রোপন করেছিলেন। সেই পেঁয়াজ তারা এখন উত্তোলন করেছেন, কিন্তু বাজারে এখনও শীতকালীন পেঁয়াজের মজুত শেষ হয়নি। ফলে তারা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।’
মহারাষ্ট্রের কৃষকনেতা অজিত নাভাল বিবিসি মারাঠিকে জানান, বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি একশ কেজি পেঁয়াজ কৃষকদের বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ২০০ থেকে ৪০০ রুপিতে। অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় মাত্র ২৫৪ থেকে ৫০৮ টাকায়।
‘যদি প্রতি ১০০ কেজি পেঁয়াজের দাম ১২০০ রুপি হতো, তাহলে কৃষকরা তাদের উৎপাদন খরচ মেটানোর পর ৪০০ রুপি মুনাফা করতে পারতেন। আমি সর্বনিম্ন মুনাফার কথা বলছি,’ বিবিসিকে বলেন অজিত নাভাল।
পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কমে গেলেও ভারতের খুচরা বাজারে তার প্রভাব নেই। অজিত নাভালের মতে, বাজারের মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা পাইকারি বাজারে দাম কম হওয়ার সুযোগে মুনাফা লুটছেন— আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষকদের এ অভিযোগ স্বীকার করেছেন খামার বিশেষজ্ঞ শ্রীকান্ত কুয়ালেকারও। তিনি বলেন, ‘ভারতে আসলে ফসল বাজারজাত করা বা দাম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কোনো নীতি নেই। যখন কোনো কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যায়, সরকার সেটির রপ্তানি বন্ধ করে দেয়— এ পর্যন্তই।’
‘কিন্তু এর ফলে অনেক সময় বিভিন্ন দেশে ফসল রপ্তানি সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি থেকেও পিছু হটতে হয় আমাদের। এটা বাণিজ্যিক লেনদেনের বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য ক্ষতিকর।’
দাগু খোটে নামের এক কৃষক বিবিসি মারাঠিকে বলেন, ‘চলতি বছর মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম, বাড়িঘরও মেরামত করা দরকার ছিল। কিন্তু এখন তা অসম্ভব। পাওনাদারেরা এখন থেকেই টাকার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে।’
‘হাতে এখন কোনো অর্থ নেই। নিজের জমি থাকা সত্ত্বেও পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত অন্যের ক্ষেতে জন মজুরি খাটতে হবে আমাকে।’