কয়েক দিনের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মাঝে তাইওয়ান প্রণালীতে শুরু করা মহড়ার দ্বিতীয় দিনে তাইওয়ানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে নিশানা বানিয়ে মহড়া চালিয়েছে চীন। এই দ্বীপ ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রোববার চীন একাধিক যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজের সমাবেশ ঘটিয়েছে বলেও জানিয়েছে। মহড়ার নিন্দা জানিয়ে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীকে পর্যবেক্ষণ করার কথা জানিয়েছে তাইওয়ান।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারের সাথে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইন-ওয়েনের বৈঠকে ক্ষুব্ধ চীন শনিবার সামরিক মহড়া শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাই ইন-ওয়েনের ফেরার একদিন পর তাইওয়ান প্রণালীতে তিন দিনের সামরিক মহড়া শুরু করে চীন।
গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার কেভিন ম্যাককার্থির সাথে লস অ্যাঞ্জেলসে সাইয়ের বৈঠকের তীব্র নিন্দা জানায় বেইজিং।
গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত তাইওয়ানকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে চীন। বেইজিং শেষ পর্যন্ত বেয়ারা এই প্রদেশ চীনের সঙ্গে একীভূত হবে বলেও বিশ্বাস করে। আর সেটি করতে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগও করা হতে পারে বলে দীর্ঘদিন ধরে হুঁশিয়ার করে আসছে চীন।
কিন্তু তাইওয়ানের অনেকেই স্বশাসিত এই দ্বীপ ভূখণ্ডকে আলাদা রাষ্ট্র মনে করেন। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও এই অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়নি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াশিংটন এবং বেইজিংয়ের বিবাদের আরেকটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তাইওয়ান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ইস্যুতে কূটনৈতিক তৎপরতাও ব্যাপক জোরদার করেছে।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে বলা হয়েছে, তাইওয়ানের চারপাশে যুদ্ধের টহল এবং মহড়া অব্যাহত রয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, চীনের থিয়েটার জয়েন্ট অপারেশন কমান্ড সেন্টারের অধীনে সামরিক বাহিনীর একাধিক ইউনিট তাইওয়ান দ্বীপ ও
এর আশপাশের সমুদ্র অঞ্চলের মূল লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত যৌথ হামলার মহড়া চালিয়েছে। দ্বীপের চারপাশে আক্রমণাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি বজায় রাখা হয়েছে।
চীনের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটার কমান্ড স্থানীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাটে তাইওয়ানের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার আদলে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে সংক্ষিপ্ত অ্যানিমেশন প্রকাশ করেছে। এতে স্থল, সমুদ্র এবং আকাশ থেকে তাইওয়ানে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র দেখানো হয়েছে। তাইওয়ানের দু’টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার সাথে সাথে বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যাওয়ার চিত্রও দেখা গেছে ওই অ্যানিমেশনে।
ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাথে পরিচিত একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, তাইওয়ানের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের জলসীমায় ‘বিদেশী সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে’ বিমান ও সমুদ্র হামলার মহড়া চালিয়েছে চীন।
গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্র বলেছে, ‘কেবল তাইওয়ানই চীনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। এটা অত্যন্ত উত্তেজনাকর।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, রোববার তাইওয়ানের আশপাশে এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমান, এইচ-৬ বোমারু বিমানের পাশাপাশি ১১টি যুদ্ধজাহাজসহ ৭০টি চীনা বিমানের মহড়া দেখা গেছে।
চীনের স্থল-ভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা পিপলস লিবারেশন আর্মির ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীর দিকে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তাইওয়ানের এই মন্ত্রণালয়।
শনিবার মহড়া শুরুর পরপরই স্থানীয় সময় বিকেল ৪ টার দিকে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, অন্তত ৭১টি চীনা বিমান তাইওয়ান প্রণালীর মধ্যরেখা অতিক্রম করছে। এসব বিমানের মধ্যে যুদ্ধবিমান, বোমারু বিমান ও চীনা রণতরীও রয়েছে।
তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী ‘সংঘাত বৃদ্ধি বা বিরোধ সৃষ্টি করবে না’ এবং চীনের মহড়ার ‘যথাযথ’ জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
নিরাপত্তা সূত্র বলেছে, প্রায় ২০টি সামরিক জাহাজ তাইওয়ান প্রণালীর মধ্যরেখার কাছে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। এসব যুদ্ধজাহাজের অর্ধেক তাইওয়ানের এবং বাকিগুলো চীনের। জাহাজগুলো তাইওয়ান প্রণালীতে উভয়পক্ষের মাঝে অনানুষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করলেও কোনও ধরনের উসকানিতে লিপ্ত হয়নি।
চীনের বিমানবাহী রণতরী শানডং এখন তাইওয়ানের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল থেকে ৪০০ নটিক্যাল মাইলেরও বেশি দূরে রয়েছে এবং মহড়া চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি। তাইওয়ান গত সপ্তাহ থেকে এই রণতরীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে।
চীনের একাডেমি অব মিলিটারি সায়েন্সেসের কর্মকর্তা ঝাও জিয়াওঝুও চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসকে চীন এই প্রথম তাইওয়ানের লক্ষ্যবস্তুতে হামলার আদলে মহড়া চালাচ্ছে বলে প্রকাশ্যে বলেছেন।
তাইওয়ানের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর পাশাপাশি বিমানবন্দরের রানওয়ে, সামরিক স্থাপনা ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তু ‘প্রয়োজনে এক হানায় ধ্বংস করা’ হবে বলে জানিয়েছেন ঝাও।
এদিকে, চীন হামলার মহড়া চালালেও তাইওয়ানের বাসিন্দাদের মাঝে তা নিয়ে কোনও ধরনের আতঙ্ক বা উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না। বরং স্বাভাবিক জীবনযাপন অব্যাহত রেখেছেন তারা।