চাঁদের অজানা অনেক তথ্য বিশ্বের বুকে পাঠিয়ে দেয় চন্দ্রযান-১, চাঁদ যেভাবে ছুঁয়ে ফেলল ভারত

২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর। ওইদিন ভারতের মহাকাশযান চন্দ্রযান-১ যাত্রা শুরু করেছিল চাঁদের উদ্দেশে। পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে মহাকাশযান পাঠাতে নিজেদের প্রস্তুতির জানান দিতে এই অভিযান পরিচালনা করে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-ইসরো।

চাঁদের অজানা অনেক তথ্য বিশ্বের বুকে পাঠিয়ে দেয় চন্দ্রযান-১। ভারতের এই মহাকাশযান চাঁদে পানির অস্তিত্ব প্রথম খুঁজে পেয়ে ইতিহাস গড়ে। কিন্তু ভারতীয় এই মহাকাশযানকে চাঁদের পৃষ্ঠে বিধ্বস্ত করা হয়। বিজ্ঞানীদের অনেকেই দাবি করেন, চন্দ্রযান-১ ইচ্ছাকৃতভাবে বিধ্বস্ত করেছিলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা।

১০০ কিলোমিটার উঁচু থেকে চন্দ্রযান ছেড়ে চাঁদের দিকে নামতে শুরু করে চন্দ্রযান-১। কোনও বাধা ছাড়াই মহাকাশ থেকে চাঁদের বুকে আছড়ে পড়তে যানটির সময় লেগেছিল ২৫ মিনিট। আর এতেই বাজিমাত করে অত্যাধুনিক যানটি।

মহাশূন্য থেকে চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ার সময়ের ২৫ মিনিটেই ইতিহাস তৈরি গড়ে চন্দ্রযান-১। সেই যানের পাঠানো ছবিতেই চাঁদে পানির অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা।

dhakapost
গুজরাটের আহমেদাবাদের সায়েন্স সিটির এক অডিটরিয়ামে চন্দ্রযান-৩ এর চাঁদে অবতরণের মুহূর্ত সরাসরি দেখছেন লোকজন
এরপর প্রায় কেটে গেছে ১৫ বছর। আজ বুধবার ভারতের আরেক মহাকাশযান চন্দ্রযান-৩ চাঁদের রহস্যে ঘেরা অজানা দক্ষিণ মেরুর মাটি ছুঁয়ে ইতিহাস গড়েছে। ভারতের এই মাইলফলক চন্দ্রযান-২ অবতরণের প্রচেষ্টার সময় বিধ্বস্ত হওয়ার প্রায় চার বছর পর এসেছে। পুরো ভারত আজ ইসরোর বিজ্ঞানীদের সাথে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে।

বুধবার চাঁদের পৃষ্ঠে অভিকর্ষ আর গতির কৌশলী নৃত্যের মাধ্যমে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার বিক্রমকে অবতরণ করেছে ইসরোর বিজ্ঞানীরা। বিক্রম তার গন্তব্যস্থলের প্রায় ২৫ কিলোমিটার ওপর থেকে ভারতের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৫ টা ৪৫ মিনিটের দিকে অবতরণের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করে।

১৪০ কোটি ভারতীয় সফল এক অভিযানের আশায় তাকিয়ে থাকে চন্দ্রপৃষ্ঠের দিকে। কোটি কোটি মানুষ প্রার্থনায় লিপ্ত হয় চন্দ্রযান-৩ এর সফলতা কামনা করেন। অবশেষে বিক্রম ঠিক তাই করে, যা চেয়েছে ভারতবাসী।

ঘড়ির কাটা তখন ৬ টা ৪ মিনিটে। বেঙ্গালুরুর মিশন কন্ট্রোল রুমে উল্লাসে ফেটে পড়েন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। কারণ তাদের পাঠানো মহাকাশযান চন্দ্রযান-৩ এর বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদের অস্পৃশ্য দক্ষিণ মেরুর মাটি ছুঁয়ে ফেলেছে তখন। ইসরোর বিজ্ঞানীদের উল্লাসের সাথে মেতে ওঠে পুরো ভারত।

৫ আগস্ট চন্দ্রযান-৩ চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করার পর ১৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে চাঁদের চারপাশে ঘুরছিল। পৃথিবী এবং এর গন্তব্যের মাঝের প্রায় ৪ লাখ কিলোমিটার দীর্ঘপথ শেষ করে চূড়ান্ত অবতরণের পথে ছিল বিক্রম।

dhakapost
চাঁদের পৃষ্ঠে নামছে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার বিক্রম
গত ১৪ জুলাই ভারতের শ্রীহরিকোটা থেকে উৎক্ষেপিত এই মহাকাশযান তার যাত্রায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিল। কারণ পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ব্যবহারের মাধ্যমে অতিরিক্ত গতি অর্জন করে মহাকাশের শূন্য বুকের মাঝ দিয়ে ছুটছিল চন্দ্রযান-৩।

চন্দ্রযান-৩ এর এই অভিযান ছিল অজানা এক চ্যালেঞ্জে ঘেরা। ভারতীয় এই মহাকাশযান চাঁদের এমন এক অঞ্চলে অবতরণ করেছে, যা এতদিন ছিল অস্পৃশ্য এবং অনাবিষ্কৃত। ভারতই প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মহাকাশযান অবতরণ করে ইতিহাস গড়েছে।

ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে ছুঁয়েছে, যেখানে দিনের বেলায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর এবং রাতে মাইনাস ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। চাঁদের এই প্রান্ত এতদিন ছিল অজানা। ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মহাকাশযান অবতরণ করা বিশ্বের প্রথম দেশ। আর সামগ্রিক অভিযানের দিক থেকে চতুর্থ। ভারতের আগে চাঁদে মহাকাশযান পাঠিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন।

চাঁদের দক্ষিণ প্রান্তের অসম উচ্চতা, হাজার হাজার গভীর গর্ত আর মাটি থেকে উঠে আসা শত শত প্রতিবন্ধকতায় ভূখণ্ডটি আন্তঃগ্রহীয় অবস্থানে চন্দ্রযান-৩ এর অবতরণ ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। চন্দ্রযান-৩ এর অবতরণ প্রচেষ্টার মাত্র কয়েকদিন আগে রাশিয়া তার পাঠানো মহাকাশযান লুনা-২৫ হারিয়েছে। ঠিক একই অঞ্চল থেকে প্রায় ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবতরণ করেছে বিক্রম।
চন্দ্রযান-৩ চাঁদের মাটি ছুঁয়ে ফেলার মুহূর্তে বেঙ্গালুরুতে ইসরোর কন্ট্রোল রুমে উল্লাসে ফেটে পড়েন বিজ্ঞানীরা
মহাকাশযানটি অবতরণ করায় সবার চোখ এখন বিজ্ঞানের দিকে। পরবর্তী ১৪ দিন ওই অঞ্চলটি সূর্যের আলোতে আলোকিত হওয়ার সময় চন্দ্রযান-৩ এর দিকে নজর রাখবেন বিজ্ঞানীরা। ইসরো বলেছে, অঞ্চলটি আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলে ‘বিক্রম’ ও রোভার ‘প্রজ্ঞান’র অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেতে পারে। এই মিশনের এক চান্দ্রদিন বা পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান একটি সময়সীমা রয়েছে।

এই দুই যান চাঁদের ভূ-কাঠামো, এর খনিজসম্পদ এবং ভবিষ্যতে মানুষের অনুসন্ধানের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং মূল্যবান তথ্য-উপাত্ত ইসরোর কাছে পাঠাবে; যা ভবিষ্যতে চন্দ্রাভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে সহায়তা করবে। চাঁদের পৃষ্ঠে চন্দ্রযান-৩ অভিযানের ফল কেবল ভারত নয়, বরং বিশ্বজুড়ে মহাকাশ গবেষণার সব সংস্থা উপকৃত হবে। ভারতের এই অভিযানকে আধুনিক চাঁদের দৌড়ের কেবল শুরু বলা হচ্ছে।

  • কী আছে দক্ষিণ মেরুতে?
  • আগামী দিনে পৃথিবীর বাইরে যদি কখনও মানুষের বসবাসের জায়গা তৈরি হয়, তাহলে সবার আগে দরকার হবে পানির। তাই পৃথিবীর বাইরে এই একটি বস্তুই হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সেই পানির সন্ধান মিলতে পারে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
  • ইতিমধ্যে চন্দ্রযান-১ এবং চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার চাঁদে খনিজ সম্পদ এবং পানির উপস্থিতির সন্ধান দিয়েছে।
  • পরে বিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা করে দেখেছেন, চাঁদের এসব এলাকায় অজস্র খাদের গভীরে যেহেতু কখনও সূর্যের আলো প্রবেশ করেনি, তাই সেখানে থাকতে পারে জলীয় বরফ। সেই বরফেরই সন্ধান করবে চন্দ্রযান-৩।
  • চাঁদের এই দক্ষিণ মেরুতে যে কূপের মতো গর্ত রয়েছে, তা থেকে আরও তথ্য পাওয়ার আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। চাঁদের আগ্নেয়গিরি এমনকি প্রাচীন সমুদ্রের উৎসেরও খোঁজ করবেন তারা।
  • চাঁদের এই মেরুতে অভিযাত্রী যান ‘প্রজ্ঞান’র ঘুরে বেড়ানোও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ মেরুর এই আঁধারে মোড়া এলাকায় প্রায়ই উল্কাপাত হয়। যখন-তখন ছিটকে আসে গ্রহাণুও। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চন্দ্রযান-৩ কে বাঁচিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জও অনেক।
  • চন্দ্রাভিযান কত অর্থ খরচ করল ভারত?
    চাঁদের অনাবিষ্কৃত দক্ষিণ মেরুতে প্রথম কোনও দেশ হিসেবে নিজেদের মহাকাশযান চন্দ্রযান-৩ এর সফল অবতরণ করেছে ভারত। বুধবার ভারতের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪মিনিটে চাঁদের মাটি স্পর্শ করে ইতিহাস গড়েছে চন্দ্রযান-৩। পৃথিবীর আর কোনও দেশ সেখানে এখন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। ঐতিহাসিক এই মুহূর্তের সাক্ষী হতে ভারতীয়দের পাখির চোখ ছিল চন্দ্রপৃষ্ঠের অনাবিষ্কৃত দক্ষিণ মেরুতে।

ভারতজুড়ে আনন্দের বন্যা শুরু হয়েছে সফল এই অভিযান ঘিরে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গর্বের সাথে বলেছেন, আমাদের এই অভিযানের সুফল কেবল ভারত নয়, বরং পুরো বিশ্ব ভোগ করবে। ব্রিকসের সম্মেলনে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। সেখান থেকে সরাসরি ভিডিও লিংকে যুক্ত হয়ে দেশবাসীর সঙ্গে গর্বের এই মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন তিনি।

দেশটি চন্দ্রযান-৩ চাঁদে কোনও ধরনের ঝামেলা ছাড়াই সফলভাবে অবতরণ করার পর ভারতের মহাকাশযাত্রার খরচ নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম অর্থ ব্যয়ে কীভাবে সফল চন্দ্রাভিযান চালাল ভারত, সেটিও নতুন করে আলোচনা উসকে দিয়েছে।

ভারতের চন্দ্রযান-৩ কে চাঁদে পাঠানোর এই মিশনে খরচ হয়েছে ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন রুপি (সাড়ে ৭ কোটি ডলার)। বাংলাদেশি প্রায় ৮২০ কোটি ৮০ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকা। যা গত রোববার চাঁদের পৃষ্ঠে বিধ্বস্ত হওয়া রাশিয়ার মহাকাশযান লুনা-২৫ এর পেছনে ব্যয় (২০০ মিলিয়ন ডলার) হওয়া অর্থের অর্ধেকেরও কম।

ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের পূর্ববর্তী চাঁদ ও মঙ্গল মিশনগুলোও অল্প খরচে পরিচালিত হয়েছে। অর্থ অপচয় রোধে দেশটির মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর প্রচেষ্টাকে কৃতিত্ব দেন ভারতীয়রা।

কেন ভারতের মঙ্গল মিশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও কম খরচ হয়েছে তা ব্যাখ্যা করে ব্রিটেনের মহাকাশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক অ্যান্ড্রু কোটস বিবিসিকে বলেছেন, ভারত মঙ্গল নভোযানের পেলোড ১৫ কেজিতে সীমিত রেখেছিল, যা সফল মিশনটিকে তুলনামূলক ‘ছোট’ রেখেছে।

ইসরোর জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা বিবিসি তামিলকে বলেছেন, ভারতের উৎক্ষেপণ খরচ এখন আরও কম হতে পারে। কারণ দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর কুলাসেকারাপট্টিনামে একটি নতুন মহাকাশবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। এই ধরনের অভিযানের আদর্শ উৎক্ষেপণ অবস্থানের সেই বন্দরটি পরিবহন খরচ কমাবে।

Spread the love

Leave a Reply

Specify Facebook App ID and Secret in the Super Socializer > Social Login section in the admin panel for Facebook Login to work

Specify Twitter Consumer Key and Secret in the Super Socializer > Social Login section in the admin panel for Twitter Login to work

Specify LinkedIn Client ID and Secret in the Super Socializer > Social Login section in the admin panel for LinkedIn Login to work

Specify Youtube API Key in the Super Socializer > Social Login section in the admin panel for Youtube Login to work

Specify Google Client ID and Secret in the Super Socializer > Social Login section in the admin panel for Google and Youtube Login to work

Specify Instagram App ID and Instagram App Secret in the Super Socializer > Social Login section in the admin panel for Instagram Login to work

Your email address will not be published. Required fields are marked *