ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে জনসম্মুখে দুই নারীকে যৌন নিপীড়নের একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর ব্যাপক বিক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় শুরু হয়েছে। পুলিশ অপহরণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে অন্তত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং আরও অন্তত ৩০ জনকে খুঁজছে। রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় হিন্দু মেইতি ও খ্রিষ্টান কুকি সম্প্রদায়ের জাতিগত সংঘাতের সময় জঘন্য ওই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
• কী ঘটেছিল মণিপুরে?
গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মণিপুরের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, কুকি-জো জনগোষ্ঠীর দুই নারীকে নগ্ন অবস্থায় রাস্তায় ঘোরানো হচ্ছে। মেইতি সম্প্রদায়ের শত শত সদস্য ওই দুই নারীকে বার বার যৌন হয়রানি ও হেনস্তা করছে।
গত ৩ মে মণিপুরে জাতিগত সহিংসতার পর রাজ্যে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে কারণে ভিডিওটি ধারণের দুই মাসের বেশি সময় পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়।
চাকরিতে কোটা এবং জমির অধিকার নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতি ও সংখ্যালঘু কুকি-জো সম্প্রদায়ের মাঝে সেই সময় সহিংসতা শুরু হয়। এরপর থেকে রাজ্যজুড়ে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছে।
• সহিংসতার শুরু কীভাবে?
মেইতি সম্প্রদায়ের চাকরি ও কলেজে ভর্তির কোটার দাবির প্রতি আদালতের ইতিবাচক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে কুকি-জো সম্প্রদায়। দীর্ঘদিন ধরে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, মেইতি সম্প্রদায় বর্তমানে উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর জন্য সংরক্ষিত এলাকায় জমি কেনার অনুমতি পাবে। কুকি-জো সম্প্রদায় আদালতের এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ।
গত মে মাসে মণিপুরের মেইতি এবং কুকি সম্প্রদায়ের মাঝে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩০ জনের প্রাণহানি এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ৩২ লাখ বাসিন্দার এই রাজ্যে বিশৃঙ্খলার শুরু হয়েছিল মে মাসের প্রথম দিকে।
রাজ্যের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কুকি গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে সেখানে দফায় দফায় আন্দোলন হয়। মণিপুর রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ শতাংশ মেইতি সম্প্রদায়ের। তারপরও ওই রাজ্যের মোট ভূখণ্ডের মাত্র ১০ শতাংশের মালিকানা এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের হাতে রয়েছে। ভারতের এই রাজ্যে তফসিলি উপজাতিদের বাইরে পাহাড়ী এলাকায় অন্য কারও জমি কেনার অনুমতি নেই।
সম্প্রতি ভারতের হাই কোর্ট মেইতি সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতিদের তালিকার অন্তর্ভূক্ত করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। হাই কোর্টের এই নির্দেশের পর নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মণিপুর। মেইতি সম্প্রদায়ের সদস্যরা তফসিলি উপজাতিদের তালিকায় ঠাঁই পেলে রাজ্যে জমি কেনার অনুমতি পাবেন।
গত জুন মাসে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের কাছে দেওয়া এক প্রতিবেদনে রাজ্যের সুশীল সমাজের নেতৃত্বদানকারী গোষ্ঠী মণিপুর ট্রাইবাল ফোরাম বলেছে, ধর্ষণ, শিরশ্ছেদসহ অনেক সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও রাজ্য কর্তৃপক্ষ সেসব তদন্ত করেনি।
• কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে?
যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন খুইরেম হেরোদাস মেইতি সম্প্রদায়ের সদস্য। তাকে গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করেছে রাজ্য পুলিশ। ৮০ দিনের নীরবতা ভেঙে মণিপুরের সহিংসতার ঘটনায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিন্দা জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খুইরেমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নরেন্দ্র মোদি দুই নারীকে প্রকাশ্যে নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরানো ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাকে ‘লজ্জাজনক’ আখ্যা দিয়ে এর তীব্র নিন্দা ও দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ভাইরাল ভিডিওটি দেখে তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। অপরাধীদের গ্রেপ্তারে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, সেই বিষয়ে শীর্ষ এই আদালতকে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ‘কর্তৃপক্ষ যদি কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে আমরা করবো।’
নরেন্দ্র মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন মণিপুরের রাজ্য সরকার বলেছে, ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এক টুইট বার্তায় বলেন, এই ঘটনার বিষয়ে ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত’ চলছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা সব অপরাধীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করবো। এমনকি তাদের সর্বোচ্চ সাজার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।’
• জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া কেমন?
দুই নারীকে নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরানোর ভিডিওটি ভারতজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ-প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা ব্যবস্থা নিতে কালক্ষেপণ করায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, মণিপুরের নারীরা প্রধান সন্দেহভাজনের বাড়িতে হামলা চালিয়েছেন। রাজ্যের রাজধানী ইমফলের পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হেমন্ত পান্ডে বলেছেন, স্থানীয় নারীরা একটি গ্রামের প্রধান অভিযুক্তের বাড়ির কিছু অংশ পুড়িয়ে দিয়েছেন। তারা বাড়িটিতে ঢিলও ছুড়েছেন।
ভারতের নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিনের প্রশ্ন রয়েছে। সর্বশেষ ওই ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবিতে ভারতের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা দেশটির কয়েকটি অংশে বিক্ষোভ করেছে। নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া উইমেন ইনিশিয়েটিভ ফর পিসের কর্মকর্তা বিনালক্ষ্মী নেপ্রাম বলেছেন, ‘আজকে মণিপুরে আমরা যা দেখছি, তা আমাদের ইতিহাসের অন্যতম এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়।’
‘আমাদের বোনদের সাথে যা ঘটেছে— এটি এবং গত ৩ মে থেকে মণিপুরে আরও অনেক যৌন নিপীড়নের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে; যা অপ্রকাশিত রয়েছে। সেখানে যৌন নিপীড়ন, সংঘাতের সময় ধর্ষণ এবং ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’
সূত্র: আল-জাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি।