বৃষ্টি হলেই ডুববে চট্টগ্রাম— এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এটি যেন নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে ‘চাটগাঁবাসী’র অবর্ণনীয় দুর্ভোগ কোনোভাবেই শেষ হচ্ছে না।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে চারটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে শুরু হওয়া এসব প্রকল্পে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা।
বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হলেও বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের জল-ভোগান্তি দূর করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। উল্টো দিন দিন বেড়েই চলেছে ভোগান্তি। এর কারণ হিসেবে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আলাদা আলাদা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। উদ্দেশ্য একই হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এ তিন সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। প্রকাশ্যে একটি সংস্থা অন্যটিকে দোষারোপ করছে আর যে যার মতো করে কাজ করছে।
এদিকে নগরের নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বহু নালায় জমেছে ময়লা ও পলিথিনের স্তূপ। নালা পরিষ্কারের দায়িত্ব কার, সেটা নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে চসিক-সিডিএর মধ্যে।
সিটি করপোরেশন বলছে, নালা পরিষ্কার তাদের নিয়মিত কাজ হলেও বর্তমানে এগুলো সিডিএর প্রকল্পের অধীনে রয়েছে। যেহেতু এখানে তারা (সিডিএ) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তাই নালা পরিষ্কারের দায়িত্বও তাদের। আবার নালা পরিষ্কার সিডিএর রুটিন ওয়ার্ক না হওয়ায় তারা সেটিকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। সবমিলিয়ে ৯ বছর ধরে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার নানা কাজ চলমান থাকলেও বাস্তবে নগরবাসী কোনো সুফলই পাচ্ছেন না।
জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি ও কোনোপ্রকার ত্রুটি আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে ২ বছর আগে চট্টগ্রামে এসেছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ২০২১ সালের জুনে তিনি বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্প ঘুরে দেখেন। ওই সময় তিনি নগরের সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তিনি বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান এবং সিটি মেয়র ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করে একটি তদারকি কমিটি গঠন করে দেন। কমিটি প্রতি মাসে প্রকল্পের কার্যক্রম ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে ওই কমিটির তেমন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। শুরু থেকে কমিটি কোনো প্রতিবেদন দিয়েছিল কি না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেনি জেলা প্রশাসন।
এদিকে এবছর একমাস আগে বর্ষাকাল শুরু হলেও শুরুর দিকে তেমন বৃষ্টিপাত হয়নি। মাঝে দুয়েকদিন ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ওই সময় নগরের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। এ কয়েকদিনের মধ্যে নগরের নিম্নাঞ্চলগুলো বেশে কয়েকবার একবোরে তলিয়ে গেছে। কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি উঠেছে। এতে দৈনন্দিন প্রয়োজনে বের হওয়া লোকজনকে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করছে সিডিএ। এতে সিটি করপোরেশনের কোনো হাত নেই। মানুষ শুধু শুধু সিটি করপোরেশনকে গালিগালাজ করছে। আমি সিডিএকে বারবার বলেছি, আপনারা ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করুন। কিন্তু তারা এ পর্যন্ত কি একজন কাউন্সিলরকেও কখনও ডেকেছে? চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম
কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতে বহু বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকেছে। বৃহস্পতিবার বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের বিভিন্ন দোকানেও পানি ঢোকে। এতে দোকানগুলোর ফ্লোরে থাকা মালামাল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বেচাকেনাও বন্ধ ছিল। এছাড়া শনিবার নগরের অন্যতম ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র রিয়াজ উদ্দিন বাজারেও পানি ওঠে। বারবার পানি ওঠায় পণ্য পচে লোকসান হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
বৃষ্টির পানি উঠেছে মেয়রের বাড়িতে, তাই রিকশাযোগে বের হচ্ছেন তিনি/ ছবি : সংগৃহীত
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মো. এহেসানুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৃষ্টি হলেই নগরের বিভিন্ন এলাকার সড়ক তলিয়ে যাচ্ছে। বাসা থেকে কর্মস্থলে যেতে কোথাও না কোথাও জলাবদ্ধতার কবলে পড়তে হয়। শুনেছি হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলছে, কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই দৃশ্যমান নয় এবং আমরাও কোনো সুফল পাচ্ছি না।
পাহাড়, খাল, নদী ও সমুদ্র নিয়ে গঠিত চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে পাহাড় থেকে বালি ধুয়ে নালায় পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৫ সালে ড্রেনেজ এবং জলাবদ্ধতার জন্য আলাদা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চট্টগ্রামে যেসব প্রাকৃতিক জলাধার, খাল, নদীনালা এবং পুকুর ছিল আমরা সেগুলো ধ্বংস করেছি।
হাসান বিন শামস বলেন, আমাদের প্রকল্পের অধীনে ২১টি খাল খনন করা হয়েছে, বাকি ১২টি খাল এখনো খনন করা হয়নি। এগুলোর জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। কারণ প্রকল্প নেওয়ার সময় মৌজা মূল্যে দেড় গুণ দেওয়া লাগত, এখন এটি তিনগুণ হয়েছে। প্রকল্পের নতুন প্রস্তাবনা আরও দেড় বছর আগে দিয়েছি কিন্তু এখনো অনুমোদন হয়নি। এ কারণে কাজ থেমে আছে। যেমন প্রবর্তক মোড় থেকে চাক্তাই খালে পানি নামার জন্য একটা হিজরা খাল করা হচ্ছে সেটির ৩ কিলোমিটার করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের জন্য বাকি ৩ কিলোমিটার করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে ওই এলাকার পানি নামতে পারছে না। জমি অধিগ্রহণের টাকা পাওয়ার পর কাজ শেষ করতে আরও দুই বছর লাগতে পারে।
সিডিএর এ প্রকৌশলী বলেন, ১৭টি খালের মুখে স্লুইস গেট বসানোর কথা। এর মধ্যে ৫টি বসানো হয়েছে। এর মধ্যে আগ্রাবাদ এলাকায় বসানো হয়েছে, ওই এলাকায় কিন্তু এখন জলাবদ্ধতা হচ্ছে না। বাকি স্লুইস গেটগুলোর স্ট্রাকচার হয়ে গেছে। কিন্তু যন্ত্রপাতি আসেনি। এগুলোর কাজ শেষ হতে আরও দুই বছর সময় লাগতে পারে। সবশেষ আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। শহরে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন হয়, তার মাত্র ২০ শতাংশ ডাম্পিং স্টেশনে যায়। বাকি বর্জ্য নালা কিংবা খালে পড়ে। চাক্তাই খাল তিন চতুর্থাংশ ময়লায় ভরা। এ কারণে এটি দিয়ে যথাযথভাবে পানি নামতে পারছে না। এজন্য সিটি কর্পোরেশনকে বর্জ্য রিসাইকেল করতে হবে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, পাহাড়, খাল, নদী ও সমুদ্র নিয়ে গঠিত চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে পাহাড় থেকে বালি ধুয়ে নালায় পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৫ সালে ড্রেনেজ এবং জলাবদ্ধতার জন্য আলাদা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চট্টগ্রামে যেসব প্রাকৃতিক জলাধার, খাল, নদীনালা এবং পুকুর ছিল আমরা সেগুলো ধ্বংস করেছি। তার চরম প্রতিক্রিয়া আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে পাচ্ছি। এক্ষেত্রে সরকার অনেক চিন্তা করে বিপুল পরিমাণ আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রচুর সমন্বয়হীনতা দেখতে পাচ্ছি। এছাড়া বেদখল হয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাধার যখন উদ্ধারে যাওয়া হচ্ছে তখন মামলা সংক্রান্ত নানা জটিলতা সামনে আসছে।
তিনি বলেন, আবার সিডিএর মাধ্যমে এখন যেসব খাল পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব ছিল এগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। কিন্তু তারা এ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। এখানে একটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। আরেকটি বিষয়, আমরা নাগরিকরাও সচেতন নই। যত্রতত্র ময়লা ফেলার কারণে নালাগুলোতে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া সিডিএর মাধ্যমে যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংস্থাটির সমন্বয়হীনতা হচ্ছে। ফলে যেসব কাজ হয়েছে তার পরিপূর্ণ সুফল আমরা পাচ্ছি না। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সিএস আরএস নকশাভুক্ত সকল খাল পুনরুদ্ধারে যেতে হবে। চট্টগ্রাম মহানগরীর যে মাস্টারপ্ল্যান ছিল সে অনুযায়ী সকল পুকুর পুনরুদ্ধারে যেতে হবে। এছাড়া উদ্ধার করা নদী ও খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে এবং জনগণকেও যত্রতত্র ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে।
নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বহদ্দারহাট বারৈপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিটি কর্পোরেশন। ২০১৪ সালে ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক)। ২০১৭ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নানা জটিলতায় প্রকল্পটির কাজ খুব বেশি এগোয়নি। বর্তমানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।
‘মহানগরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শিরোনামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের অধীন কর্ণফুলীতে যুক্ত ২৩টি, হালদায় যুক্ত তিনটি এবং বঙ্গোপসাগরে যুক্ত ১৪টি খালের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ৬৯টি পাম্প হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালে। কাজ শুরু হয় ২০২০ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি পাউবো। আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রকল্পের মেয়াদ এখনও বাড়ানো হয়নি, তবে ঠিকাদার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।