বিজয়ের ৫১ বছরে বাংলাদেশে যেন সব ফুল ফুটেছিল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধায়। লাল-সবুজের বিজয় নিশান আর ফুল হাতে জনস্রোত সর্বত্র। সত্যিই এক অন্যরকম উৎসবের আবহে লাল-সবুজের বর্ণিল সাজে সেজেছিল লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এক নতুন রূপে ও চেতনায় শুক্রবার মহান বিজয় দিবস উদ্যাপন করেছে দেশবাসী। বিজয়ের বাঁধভাঙা জোয়ারে সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্নে চোখ রাখা বাংলাদেশ আবারও জানাল- এ দেশ বঙ্গবন্ধুর, এ দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার। বাঙালি জাতিকে কোনো অপশক্তিই দাবায়ে রাখতে পারবে না।
যাদের রক্তের বিনিময়ে দুই যুগের পাকিস্তানি শাসন-শোষণের অবসান হয়েছিল, বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তির দিনে সেই বীর সন্তানদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে গোটা জাতি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির গণজাগরণ আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের তীব্র ঘৃণা ও গণধিক্কার ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিল এবারের মহান বিজয় দিবসে। বাংলাদেশ নামের জাতিরাষ্ট্রের জন্মদিনে অন্যরকম এক স্বস্তি ও চেতনায় বিজয়ের উল্লাসে মেতেছিল পুরো জাতি।
উগ্রবাদ-মৌলবাদ ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের একাত্তরের মতো আবারও পরাজিত, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে উৎখাত এবং মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিসহ সব আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় এসেছে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৫১তম বার্ষিকীতে। তাই মহান বিজয় দিবসে সর্বত্রই ছিল কৃতজ্ঞ বাঙালির মুখে বিজয়ের গান আর যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার ও মৌলবাদমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শপথ।
শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা সমাজের নানা স্তরের প্রতিনিধিদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছে ’৭১-এর ‘শকুনি’, পঁচাত্তরের হায়েনাদের বংশধর, নব্য রাজাকার ও তাদের দোসরদের সর্বত্র ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সেই শপথের সুর। তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছেÑ একাত্তরের সেই ঘাতক-দালাল আর তাদের আজকের দোসররা আবারও ফণা তুলে ছোবল মারতে চাইছে। এই নব্য রাজাকারদের নির্মূল করা না গেলে ভবিষ্যতেও তারা বাংলাদেশের জন্য হুমকি তৈরি করবে। রাজাকার-আলবদর ও স্বাধীনতাবিরোধী মুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথে বিজয় দিবসে একাত্তরের মতোই যেন গর্জে উঠেছিল তারা। সারাদেশে শহীদদের শ্রদ্ধাসহ নানা অনুষ্ঠানে লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে বিজয় উদ্যাপন করেছে বাংলাদেশের মানুষ।
তবে আনন্দমুখর এ উৎসবে বরাবরের মতো এবারও অন্তঃস্রোত বয়ে গেছে স্বজন হারানোর বেদনা। বিজয় দিবসের নানা আয়োজন তরুণ প্রজন্মকে দোলা দিয়েছে, স্মৃতির ঝাপিতে নাড়া দিয়েছে ইতিহাসের সেদিনের সাক্ষীদের। বাংলাদেশের সোঁদাগন্ধময় মাটির যে হৃদস্পন্দন সেখানে এই বাংলার প্রতিটি সন্তানের ভিন্ন মাত্রিক সম্পর্ক দেশপ্রেমের দর্শনকে ক্রমাগত শাণিত করেছে। এবার রাজধানীর সড়কগুলো সেজেছে লাল-সবুজের মনোরম সাজে। সড়কদ্বীপগুলোতে শোভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি সংবলিত বিল বোর্ড, বিভিন্ন স্থাপনায় হয়েছে আলোকসজ্জা।
রাজধানী ঢাকা থেকে ওঠা অসাম্প্রদায়িক উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের এই দাবি বিজয়ের দিনে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে গোটা দেশে। এভাবেই স্বস্তির পরিবেশে মুক্ত আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো করোনার মধ্যেও বিপুল মানুষের আনন্দ উচ্ছ্বাস, মহান শহীদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে জাতি পালন করল মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫১ বছর।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অলিগলি, পাড়া-মহল্লা রাজপথে বিনা বাধায় দিনভর বেজেছে জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বজ্রকঠিন ভাষণের রেকর্ড আর কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানগুলো।
বাঙালি জাতি আনন্দ, বেদনা আর বিনম্র শ্রদ্ধা স্মরণ করেছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লাখো শহীদকে, স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দিবসটির মূল অঙ্গীকারই ছিল সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ-স্বনির্ভর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার। দিবসটি ঘিরে আলোচনা, সেমিনার, বক্তৃতা ও যুক্তিতর্কসহ সবকিছুতেই ঘুরেফিরে প্রাধান্য পায় জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন এক জন্মভূমির স্বপ্নের কথাও।
রাজধানীসহ সারাদেশের রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, দোকানপাট, যানবাহন এবং বাসাবাড়িতে পতপত করে উড়েছে লাখো শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজ পতাকা। ছোট ছোট কাগজ বা কাপড়ের তৈরি পতাকা হাতে নিয়ে বা বুকে-পিঠে লাগিয়ে শিশু-কিশোররা বেরিয়ে ছিল ঘরের বাইরে। কেউ কেউ মুখে এঁকেছিল লাল-সবুজ পতাকা। বিজয় দিবসে কোথাও স্বাধীনতাবিরোধী সেই জামায়াত-শিবিরের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত নতুন প্রজন্মের সাহসী পথচলায় এবারের বিজয় দিবসে রাজনৈতিক বিতর্ক বা স্বাধীনতাবিরোধীদের কোনো আস্ফালন ছিল না।
সংবাদটি শেয়ার করুন