সোনালি আঁশ পাটে সিরাজগঞ্জের কৃষকেরা সোনালি স্বপ্ন দেখলেও সেই স্বপ্ন যেন অধরাই রয়ে গেছে। জমিতে যতটুকু পাট উৎপাদন হয়েছে তার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না বলে দাবি তাদের। উৎপাদিত পাট বিক্রি করে লাভ তো হচ্ছেই না, উলটো ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে কৃষকদের। তারা বলছেন, বাধ্য হয়ে আগামীতে আর পাট চাষ করবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একদিকে যেমন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনই ব্যবসায়ীরাও লাভবান হতে পারছেন না। তাদের দাবি, সরকারিভাবে যদি পাট রপ্তানি করা যেত তাহলে সবার জন্যই ভালো হতো। তাহলে কৃষকদের ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না।
সরেজমিনে উল্লাপাড়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, পাট কেনাবেচায় ব্যস্ত কৃষক ও পাইকাররা। হাটে তোষা, মেস্তা ও কেনাসহ বিভিন্ন জাতের পাটের প্রকার ভেদে প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ১৭০০ থেকে ২৫০০ টাকা দরে। উপজেলা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে কৃষকেরা এসেছেন পাট বিক্রি করতে। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি পাট কিনে নিচ্ছেন পাইকাররা। পাইকাররা আবার এই পাট বিক্রি করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
কৃষক ও পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিকে যেমন সার, বীজ ও উৎপাদন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জিনিসের দাম বেশি, তেমনই বেড়েছে শ্রমিকের মূল্যও। তাই উৎপাদন খরচ বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। প্রতি বিঘা জমিতে পাট উৎপাদন করতেই তাদের খরচ হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদন হয় ৫ থেকে ৭ মণ পাট। এই পাট বিক্রি করতে যাতায়াত ভাড়া আছে। সবমিলিয়ে যে খরচ তা এই মূল্যে পাট বিক্রি করে উৎপাদন খরচও উঠছেনা। ফলে হতাশ হচ্ছেন কৃষক। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সোনালি আঁশ পাট থেকে। একটু ধনী কৃষকেরা মূল্য বৃদ্ধির অপেক্ষায় এখন পাট বিক্রি না করলেও নিম্নবিত্তরা বাধ্য হয়েই বিক্রি করছেন। এ ছাড়াও সঠিক সময়ে খালবিলে বন্যার পানি না আসায় পাট জাগ দিতে সমস্যা হয়েছে অনেক কৃষকের। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন কমেছে, অন্যদিকে নষ্ট হয়েছে অনেক ফসল।
উল্লাপাড়া হাটে পাট বিক্রি করতে এসেছেন উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের মাহেল উদ্দিন প্রামানিকের ছেলে একজন সাধারণ কৃষক আব্দুস সামাদ। তিনি বলেন, পাট বুনে তো লাভ হয়নি উলটো লস হয়েছে। এক বিঘায় খরচ হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। পাট হয় ৫ থেকে ৭ মণ। প্রতিমণ পাট বিক্রি করেছি ১৯০০ টাকা দরে। তেল, সার ও কীটনাশকের দাম বেশি। তাই উৎপাদন খরচই উঠে আসছে না।
মোজদার আলী মোল্লা নামে আরেকজন কৃষক বলেন, একজন দিনমজুরের দাম ৫০০ টাকা। জমি চাষ ও সার দিয়ে অনেক খরচ হয়। পাট বিক্রি করে যে টাকা পেলাম তার চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। এখন আবাদ না করলেও চলে না তাই বাধ্য হয়েই করি।
উল্লাপাড়া হাটের পাইকারি ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ কুন্ডু রনি বলেন, অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এ বছরে প্রতি মণ পাটের দাম ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা কম। এখানকার বেশিরভাগ পাট খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিল ও কল-কারখানায় যাচ্ছে। এই পাটের তেমন কোনো চাহিদা নাই, পাটের বৈদেশিক চাহিদার পরিমাণ। আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত, মাল দিয়ে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি না। আবার মাল দিয়ে ঠিকমতো টাকাও পাচ্ছি না। কৃষকরাও ঠিকমতো টাকা পাচ্ছেনা, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান বাজার দরে সবচেয়ে নিম্নমানের পাট ১৮০০ টাকা ও সবচেয়ে ভালো মানের পাট ২৫০০ টাকা। লোকসান কমিয়ে লাভ করার জন্য পাট বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। এতে পাটের দাম ও বাজার দুটোই বাড়বে। সরকার যদি পাট বিদেশে রপ্তানি করতে পারে তাহলে কৃষকও বাঁচবে, ব্যবসায়ীরাও বাঁচবে।
আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ সরকার কে বলেন, ৪৫ বছর হলো আমি ব্যবসা করি কিন্তু এবারের মতো পাটের বাজার এর আগে দেখিনি। বর্তমান সময়ে পাটের যে দাম তাতে কৃষকের কিছুই হচ্ছে না। আমরা যে কিনে নিব, আমাদের কাছ থেকেও কেনার লোক নাই। ক্রেতা না থাকার কারণে আমরা অসুবিধায় আছি। কৃষকরা বর্তমান যে দাম পাচ্ছে তাতে তাদের লাভ তো দূরে থাক মজুরির দামই উঠবেনা। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করবো সরকার যেন এদিকে একটু নজর রাখে।
উল্লাপাড়া পাটের হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান বলেন, সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবার এই পাটের হাটটি বসে। হাটে ১ হাজার থেকে ১৫০০ মণ পাট আমদানি হয়। উল্লাপাড়া ছাড়াও জেলার বেলকুচি, কামারখন্দ ও তাড়াশসহ প্রায় প্রত্যেক উপজেলা থেকেই এখানে পাট আসে। এখান থেকে সারাদেশে পাট গেলেও বেশি যায় ঢাকা, খুলনা ও বগুড়াতে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে ৫ হাজার ৬৪৫ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৩ হাজার ৩৫০, উল্লাপাড়ায় ১ হাজার ৬২০, বেলকুচিতে ১ হাজার ৯৬০, শাহজাদপুরে ৪৩৫, তাড়াশে ৭৪৫, রায়গঞ্জে ৮৯২, চৌহালীতে ৯২০, কামারখন্দে ১ হাজার ৭৩১ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। জেলায় মোট ১৭ হাজার ২৯৮ হেক্টর জমি থেকে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৬ হাজার ২০৯ মেট্রিক টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জের উপ-পরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, সিরাজগঞ্জে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৯১০ হেক্টর। সেখানে অর্জিত হয়েছে ১৭ হাজার ২৯৮ হেক্টর। কৃষক পাটের ফলন ভালো পাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বিঘাপ্রতি গড়ে প্রায় ৮ মণ করে ফলন পেয়েছি। কৃষকরা বাজারে প্রতি মণ পাটের দাম পাচ্ছেন প্রায় ১৮০০ থেকে ২৫০০ টাকা। পাশাপাশি তারা পাটকাঠি পাচ্ছে, যা ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন।
বর্তমানে বৃষ্টি হওয়ার কারণে পাট জাগ দিতে সমস্যা হচ্ছেনা জানিয়ে তিনি বলেন, যদি কোথায় একেবারেই পানি না থাকে সে ক্ষেত্রে তারা রিবন রোটিং পদ্ধতিতে পাটের আঁশটি ছাড়িয়ে একটা চৌবাচ্চার মাধ্যমে আঁশটিকে ভিজিয়ে রেখে পঁচানোর পরে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেই হবে।
বাবলু কুমার সূত্রধর কে আরও বলেন, আমরা সাধারণত কৃষকদের আগাম জাতের পাটের চাষ করার জন্য অনুপ্রাণিত করছি। এতে তারা এর পরে আমন চাষ করতে পারে। এ ছাড়াও আমরা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের চাষাবাদ সম্পর্কে সবসময়ই নানা পরামর্শ দিয়ে আসছি।