রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম প্রতিষ্ঠানে অর্থ হরিলুট করেছেন বলে আজকালের খবরের নিজস্ব অনুসন্ধান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে জানা গেছে।
জানা যায়, অধ্যক্ষ থাকাকালীন সরকারি বেতন-ভাতা পেলেও প্রতিষ্ঠানের তিনটি শাখা থেকে দায়িত্ব ও সাংবাৎসরিক ভাতা হিসেবে এক কোটি ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ৩৭ টাকা নিয়েছেন শাহান আরা বেগম। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাড়িতে থেকেও প্রতিষ্ঠান ও সরকারি তহবিল থেকে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য খাত থেকে আদায়কৃত অর্থ ব্যাংকে জমা না দিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে সাড়ে ৭৮ কোটি টাকা খরচের নামে লুট করেছেন। গাড়ি কেনা ও জ্বালানি খরচের নামেও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া ভর্তি বাণিজ্যসহ নানাভাবে প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকা হরিলুট করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়,শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, শাহান আরা বেগম অধ্যক্ষ থাকাকালীন ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের তিনটি শাখা ক্যাম্পাস থেকে আলাদাভাবে দায়িত্বভাতা নিয়েছেন। যা বিধিসম্মত নয়। মতিঝিল বাংলা ভার্সন থেকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ৩৬ লাখ ছয় হাজার টাকা ও সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৫৮ হাজার টাকা। একই ক্যাম্পাসের ইংলিশ ভার্সন থেকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ২৮ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬ টাকা ও সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৫৫ হাজার টাকা। মতিঝিল কলেজ শাখা থেকে সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন ছয় লাখ ১০ হাজার টাকা। বনশ্রী শাখার ইংলিশ ভার্সন থেকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ২৬ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬ টাকা ও সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ১৫ হাজার। বাংলা ভার্সন থেকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ৩১ লাখ ৮৮ হাজার ৯২৯ টাকা ও সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৬৭ হাজার। মুগদা শাখা থেকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ২৬ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬ টাকা ও সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৫৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে তিনি এক কোটি ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ৩৭ টাকা অবৈধভাবে নিয়েছেন। মতিঝিল মূল ক্যাম্পাস ছাড়া অন্য দুই ক্যাম্পাস থেকে নেওয়া ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার এক টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে ডিআইএ। এছাড়া মূল ক্যাম্পাস থেকে নেওয়া ৭৮ লাখ দুই হাজার ৩৬ টাকার আইটি জমা দেননি তিনি। এই টাকার ১০ শতাংশ হারে আইটি খাতে সাত লাখ ৮০ হাজার ২০৩ টাকা জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালে শাহান আরা বেগমকে চার্জ অ্যালাউন্স বাবদ ১৭ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাড়ি ভাড়া বাবদ মূল বেতনের ৪০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ক্যাম্পাসে আবাসিক থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি প্রায় ১৮ বছর ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাসায় থেকেছেন। এসময়ে বাসার গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাড়িতে থেকেও সরকারি ও প্রতিষ্ঠানের তহবলি থেকে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। অর্থাৎ বাড়ি ভাড়া সুবিধা তিন ধাপে নিয়েছেন। ২০০৪ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া হিসেবে প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৯ লাখ ৬৮ হাজার ৪০০ টাকা নিয়েছেন। সরকারি তহবিল থেকে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন এক লাখ পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। তিনি অবসরে যাওয়ার পরে আরো দুই মাস জোর করে প্রতিষ্ঠানের বাসায় ছিলেন। সরকারি ও প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়ি ভাড়ার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে ডিআইএ’র প্রতিবেদনে।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (কলেজ-২) হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের শাখা ক্যাম্পাসের দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্ব ভাতা নেওয়ার কোনো বিধান নেই। যদি নিয়ে থাকেন তাহলে বিধি লঙ্ঘন করেছেন। বাড়ি ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাসভবনে থাকার পর সরকারি ও প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়িভাড়া তুলে থাকলে সেটাও আইন লঙ্ঘন। এসব অর্থ ফেরত দিতে হবে।
শাহান আরা বেগম অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের সময় ২০১২-২০১৩ অর্থবছর থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মতিঝিল কলেজ শাখা, মাধ্যমিক বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে মোট ৭৮ কোটি ৪১ লাখ ২৭ হাজার ১৭ টাকা ব্যাংকে জমা না রেখে ইচ্ছেমতো ভাউচার দিয়ে খরচ করেছেন। প্রতিষ্ঠানের দৈনিক খরচ করার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার নগদ রাখা যায়। কিন্তু শাহান আরা বেগম সরকারি নিয়ম না মেনে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচের নামে হরিলুট করেছেন।
জানতে চাইলে ডিআইএ’র যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, এসব অনিয়মের কারণে সরকারি বিধান অনুযায়ী অধ্যক্ষ ও জিবির বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপের মামলা করা যায়। আমাদের তদন্তে এসব অনিয়মের বিষয়ে মামলা করার সুপারিশ করেছি। তিনি জানান, এসআরও (সংবিধিবদ্ধ নিয়ামক আদেশ) ১৫৭ (১) (২), (৩), (৪) ও (৫) ধারা মোতাবেক প্রতিষ্ঠান প্রধান ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহান আরা বেগম অধ্যক্ষ থাকাকালীন প্রতিষ্ঠানের অর্গানোগ্রামে না থাকলেও দরপত্র ছাড়াই ১২ লাখ টাকায় একটি গাড়ি কিনেন। প্রতিষ্ঠানের আরো দুটি গাড়ি আছে। এসব গাড়ি মেরামত ও জ্বালানি ব্যয় অধ্যক্ষ নিজ দায়িত্বে করেছেন। জ্বালানি বাবদ ৫৩ লাখ ৭১ হাজার ১৮৪ টাকা এবং মেরামত বাবদ ১৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮২ টাকা রেজুলেশন ছাড়া খরচ করেছেন তিনি। যা বিধিবহির্ভূত। গাড়ি মেরামতের ভ্যাট এক লাখ ৩২ হাজার ৭১১ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের মোট তিনটি গাড়ি থাকলেও প্রতিটি ক্যাম্পাসের তিনটি করে মোট নয়টি গাড়ি দেখিয়ে জ্বালানিসহ মেরামতের টাকা নিয়েছেন।